সোহরাব হোসাইন চৌধুরী ::
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিটি জেলায় যেমন মুক্তি সংগ্রামে আন্দোলনে ঝাঁিপয়ে পড়ে দেশের মানুষকে অন্ধকার দেশ থেকে মুক্ত করে ছিলো বীর মুক্তিসেনারা। কক্সবাজার জেলার মুক্তি বাহিনীরাও পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি শত্রু মুক্ত কক্সবাজার উপহার দেন। এব্যাপারে যুদ্ধাকালীন কমান্ডার জেলা জয় বাংলা বাহিনীর৭১ এর প্রধান প্রবীণ রাজনীতিবীদ, শিক্ষানুরাগী, সংস্কৃতিমনা, ক্রীড়াবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী সকাশে গিয়ে আলাপক্রমে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ে অবিস্মরণীয় স্মৃতি গাঁথা জানতে চাইলে তিনি বলে জানান- বাঙ্গালীর জন্য শেখ মুজিব দিলেন বাংলাদেশ, তাঁর কন্যা নেত্রী শেখ হাসিনা বাংলার জীবন মান উন্নয়নের তরে প্রাণপন নিরলস চেষ্টায়রত। অপর দিকে, স্বাধীনতা বিরুধী চক্র ছলে-বলে কৌশলে! রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটাকে ধ্বংস করতে সদাব্যস্ত। কিন্তু তাদের চক্র সুফল পাবে না। এক পযার্য়ে বলেন, আমি স্কুল জীবন থেকেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ছিলাম। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ঠের নির্বাচনের প্রাক্কালে শের-এ-বাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমার ও আজিজ মিয়ার সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। ১৯৬২-৬৩ সালে আমি ছিলাম কক্সবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার সাংগঠনিক জেলায় ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করি এবং সভাপতি হই। বৈরুত যাওয়ার প্রাক্কালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কক্সবাজার বীচ সংশিষ্ট হাউসে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এক দূর্লভ সম্মর্ধনায় ভূষিত করা হয়। ঐ সময়েও ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। ঐ সময়ের শিক্ষা আন্দোলনেও আমরা অংশগ্রহণ করি। ১৯৬৪-৬৫ সালে আমি কক্সবাজার কলেজের প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। তিনি আরো জানান, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার জন্য আমরা সংগ্রাম করি যা ব্যাপক গণসমর্থন পেয়েছিল। ১৯৬৭-৬৮ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। ১৯৬৮-৬৯ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন কালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারন করি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে আমরা কয়েকজন যেমন- নজরুল, মোজাম্মেল, ছুরত আলম, কৃষ্ণ, তৈয়ব, রাজামিয়া, জহির প্রমূখের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী করা হয়। ১৯৬৯ এর পরিস্থিতির কারণে আমাদের চিন্তা ধারার পরিবর্তন আসে এবং আমরা স্বাধীনতার জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করি। ১৯৬৯-এর আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া “আইনগত কাঠামো আদেশে’ ১৯৭০ এ নির্বাচন ঘোষনা করেন। আমরা সেই নির্বাচনে স্বতঃস্ফুর্ত এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। নির্বাচনের ফলাফল তো সবার জানা আছে। ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির ফলে আমাদের চিন্তা ভাবনা প্রকট হয় যে, আন্দোলন জোরদার করতে হবে, প্রয়োজনে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। সেই সময়ে আমরা মহকুমা পর্যায়ে ভয়েস অব আমেরিকা এবং বি.বি.সি-র সংবাদের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সমস্ত কর্মসূচী পালন করতাম। তিনি জানান, ১৯৭১ এর ৭ই মার্চের ভাষনের আগেই ৩রা মার্চ আমরা মহকুমা প্রশাসনের অফিসের পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেই। উহা নামানো হয় মোজাম্মেল (মরহুম)- এর কাধের উপর সুরত আলম, এর উপর আল মামুন, ও দিকে পানির পাইপ দিয়ে মুজিব এক সাথে উঠে পতাকা নামিয়ে পাবলিক লাইব্রেরীর কোণায় আমতলা স্টেজে নিয়ে আসে। তখন মাইকে আমি ঘোষনা করি, “এই পতাকার নাম দিয়ে আমাদেরকে ২২/২৩ বৎসর শোষন করেছে। এর আর দরকার নাই। আমরা চাই নুতন পতাকা নুতন দেশ”- এর সাথে সাথে পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ইহা ছিল সেই দিনের কক্সবাজারের সর্বস্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলের জনতা, যে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলাম আমি স্বয়ং, নজরুল, ওমর, সুনিল, জালাল, মনছুর, জহির, হাবীব, তৈয়ব, রাজা মিয়া, তাহের, সিরাজ, দিদার, পিন্টু, শাকের, আবছার, তালেব, মুজিব, আলতাফ, শাহ আলম, হারুন, রশিদ, লক্ষন, খোরশেদ, জালাল, বাচ্চু, বেলাল প্রমুখ। বিশেষত:‘৭১-এর প্রথম দিক থেকেই আমরা গোপনে হোটেল সায়মনে ৩টি রুম নিয়ে অফিস করতে থাকি এবং ভয়েস অব আমেরিকা ও বি.বি.সি, টেলিফোন সংবাদ এর ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করি। ৭ই মার্চের অগ্নিঝরা ভাষনের নির্দেশনা সমূহ অনুসরণ করি। ৭ই মার্চের ভাষনের মর্মবানী আমাদের কাছে সস্পষ্ট হয়ে উঠে। আমরা সস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম যে, আমাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তখন থেকে আমরা ২৪/২৫ জন সিনিয়র ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী হোটেল সায়মনে অঘোষিত ক্যাম্প শুরু করি এবং ১১ই মার্চ হতে সশস্ত্র প্রস্তুতির কার্যক্রম শুরু করি। ২৫ শে মার্চ’৭১, রাত ১-৩০ এর পর কক্সবাজার পুরাতন রেষ্ট হাউস থেকে আমরা কয়েকজন চট্টগ্রাম রেষ্ট হাউসে (বর্তমান হোটেল সৈকত) সিটি আওয়ামীলীগ অফিসে জহুর আহামদ চৌধুরীর কাছে ফোন করি। ফোন ধরেন শ্রমিক নেতা জামাল। তার কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি বলেন, দেশে গণহত্যা চলছে, রাজারবাগ ই-পি.আর বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর আক্রমন হয়েছে। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। এখন চতুর্দিকে গোলাগুলি হচ্ছে। আমরা নিরাপদ স্থানের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছি। আপনারা প্রস্তুতি নেন।” আমি রিসিভারে এখান থেকেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এ কথা আমরা স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে জানালাম। তারাও বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলেন। আমি ২৬মার্চ ভোর ৬ টায় কক্সবাজার শহরের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে আনাচে কানাচে মাইকে প্রচার করেছিলাম যে, “আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ২৫ তারিখ রাত্রে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। একথা আমরা বিশ্বস্থ সূত্রে জেনেছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় পশ্চিমা লাল কুত্তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকায় পুলিশ ক্যাম্প, ই.পি.আর ক্যাম্প এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র এবং ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা চালিয়েছে। সুতরাং আমাদের আর সময় নাই। কক্সবাজারবাসী সংগ্রামী বাঙ্গালীরা যে যেখানে যেভাবে আছেন, পাশাপাশি অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে সরাসরি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। রাত ১ টার দিকে জোনাব আলী, লতিফ এবং আরও কয়েকজন কক্সবাজার ই.পি.আর এর কাছ থেকে তাদের কাছে আসা ক্যাপ্টেন রফিক-এর ম্যাসেজ এবং অবাঙ্গালী ক্লোজ করার ব্যাপারে জানি। ঐদিন সন্ধা সাড়ে ছয়টায় খরুলিয়া পর্যন্ত ঘোষনা দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। মুজাহিদ বাহিনীকে বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়বাংলা বাহিনী এবং সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশক্রমে অংশগ্রহণ করার জন্য সকাল ৮ টার মধ্যে আওয়ামীলীগ অফিসে উপস্থিত হওয়ার জন্য অতি জরুরীভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। একই ভাবে আনসার এডজুডেন্টকে এনেও এ ঘোষনা দেওয়া হয়। রাত ১১ টায় ডি.এফ.ও’র আরমারীর অস্ত্র নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু পারা যায়নি, পরের দিন ডি.এফ.ও’ কে আনিয়ে তালা খুলে অস্ত্র নেওয়া হয়। তখন আমার সাথে ছিল সুরত আলম, মোজাম্মেল (মরহুম), জমাদার ফজল করিম, মুজিব, মনছুর, জহির ও খুরশেদ। ঐদিন রাত্রে ব্ল্যাক আউট করানো হয়েছিল এবং আমি ছিলাম টেলিফোন এক্সেঞ্জ বন্ধ করার দায়িত্বে। এর পর এস.ডি.পি.ও এবং ও.সি-কে নিরস্ত্র করে থানা থেকে অস্ত্র নেওয়া হয়। বি.বি.সি এবং ভয়েস অব আমেরিকার খবরও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে সমুদ্রে সোয়াত জাহাজ ও বাবর এবং উপরে বোমারু বিমান উপস্থিতির প্রেক্ষিতে সারা শহরে এবং বিমান বন্দরে ট্রেন্স করার ব্যবস্থা করি, রানওয়ে কেটে দি। জনাব নুর আহামদ, আবছার কামাল চৌং, শমশের আলম চৌধুরী প্রমুখের একটি দল বার্মার সাথে সামরিক সহায়তায় আশায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বিফল হন। তখন কালুর ঘাটে যুদ্ধ চলছিল। আমরা সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে ৪/৫ বার কালুর ঘাটে রসদ পত্র এবং ফোর্স সরবরাহের ব্যবস্থা করি এবং আমি নিজেই এই ফোর্সের নেতৃত্ব দিই। তিনি আরো বলেন, আরও যারা আমার সাথে থাকতেন তাদের মধ্যে উলেখযোগ্য হচ্ছেন- সুরত আলম, মোজাম্মেল (মরহুম) মুজিব, কাদের, জাফর প্রমুখ এবং জয়বাংলা বাহিনীর একটি গ্রুপ। কালুর ঘাট পতনের পর আমরা আজিজ নগর, হারবাং, ফাঁসিয়াখালী, ডুলহাজরা, ঈদগাহ, রাবার বাগান, এসব জায়গায় এম্বুস বসাই। ইতিপূর্বে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ই. পি. আর একটি গ্রুপ হাবিলদার জোনাব আলীর নেতৃত্বে কালুরঘাটে যোগদান করে। এখানে আমরা টেকনাফ থেকে কুতুবদিয়া, হারবাং এবং আজিজ নগর পর্যন্ত আমাদের পূর্ন তৎপরতা অব্যাহত রাখি এবং হানাদার মুক্ত রাখি। কালুর ঘাট পতনের পর হানাদার বাহিনী প্রথমে সাতকানিয়া এসে ফিরে যায় এবং পরে চকরিয়া পর্যন্ত এসে আবার আজিজ নগরে গিয়ে অবস্থান করে। ক্যাপ্টেন হারুন পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এবং আরও বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা আহত অবস্থায় ডুলহাজরা হাসপাতালে আসে। ইতিমধ্যে এখানকার অনেক নেতৃবৃন্দ বার্মায় আশ্রয় নেয়। এই সংকটে একমাত্র জয়বাংলা বাহিনীই কক্সবাজার মহকুমায় অবস্থান করে।
এ সময় গোটা কক্সবাজার সম্পূর্ণ নেতৃত্ব শুণ্য অবস্থায় পড়ে থাকে। টেকনাফ সীমান্তের বিক্ষিপ্ত ই.পি.আর’ দেরকে আমরা ধুমধুম ক্যাম্পে সংঘবদ্ধ করি। ইতিমধ্যে ৫ই মে প্রায় ১১৫টি গাড়ীর এক হানাদার বাহিনীর বহর কক্সবাজার আসে এবং কক্সবাজারের পতন হয়। চিরিঙ্গা, রামু, কক্সবাজার তাদেরকে অনেকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে। এর পরই তারা সর্বত্র ধরপাকড়, মারাধরা, জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে । এরপর আমরা লিংক রোডের দক্ষিণ দিকে সরে পড়ি এবং প্রতিরোধের চেষ্টা করি। উল্লেখ যে, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইউ.ও. টি. সি ক্যাপ্টেন ফরহাদ একটি ছোট দল নিয়ে আমাদের জয়বাংলা বাহিনীর সাথে যুক্ত হয় পি. টি. আই হোষ্টেল মাঠে, তখন আমরা আবার জঙ্গল পথে র্যাকি এবং এম্বুস করে প্রতিরোধের জন্য নব উদ্দীপনায় অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার চেষ্টা চালাই। ফরহাদ গ্রুপকে আনসার ক্যাম্পে এল.এম.জি সরবরাহ করার জন্য পাঠানো হলে আনসারের একটি গ্রুপ পাল্টা ফরহাদ গ্রুপকে হামলা করে বাহারছড়ায় ফরহাদ প্রমুখকে গুলিবিদ্ধ করে। আহত অবস্থায় ফরহাদ হামাগুড়ি দিয়ে বল্যা পাড়ায় সুফী সাহেবের কাঠের বাসায় আশ্রয় নেয়। তখন কিছু পথ ভ্রষ্ঠ আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে তাদেরকে ধরে মুজাহিদ ক্যাম্পে আই. ডাব্লিউ. টি. এ বিল্ডিং এ নিয়ে আসে। পরে থানা হয়ে জেলে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধারের জন্য আমরা থানায় আসি। থানায় এস.ডি.পি.ও. ও.সি এবং দালাল নেতাদেরকে মিটিং রত অবস্থায পাওয়া গেল। থানায় তারা আমাদের সামনে পাকিস্তানী পতাকা নামায় এবং বাংলাদেশ পতাকা তোলে আর ফরহাদকে মুক্তির আশ্বাস দেয়। তারা প্রশাসনের সর্বস্তরের নেতাদের এক সভা করার প্রস্তাব দেয় যা ছিল প্রকৃতপক্ষে এক চরম ধাপ্পাবাজী। ইতিমধ্যে আমরা জানতে পারলাম যে, আমরা পাল্টা আক্রমনের শিকার হচ্ছি। তাই আমরা আামাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পি.টি আই-তে চলে গেলাম। ততক্ষনে তারাই আমাদের আগে আমাদের পথ বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানতে পাই। তখন আমরা দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত আমাদের ই.পি.আর. এবং সহযোদ্ধাদের আনতে যাই, স্বল্প সময়ের মধ্যে ৫ ক্যাম্পের ৩১ জন সবাইকে ধুমধুম ক্যাম্পে নিয়ে আসি এবং মে মাসের ৬/৭ তারিখের দিকে পরিস্থিতির কারণে প্রস্তুতির সবাই বার্মায় চলে যাই। বার্মায় গিয়ে দেখি আমাদের উপর এক বিপদ, বার্মা সরকার আমাদের নেতা- এম.পি.দের কে মংডুতে নিয়ে বন্দী করে রাখে। আমি বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সিপাহী, রাজা মিয়াসহ খুল্যা মিয়া নামক এক মুসলমানের ঘরে আশ্রয় নিই। ঐ সময়ে প্রায় ৬০ হাজারেরও অধিক শরনার্থীকে সন্দেহভাজন অস্ত্রধারী হিসাবে রাজনৈতিক সচেতনদেরকে টংবৈয়ৃ, নাকখোরা, বলিবাজার, সাব বাজার, এলাকা থেকে সংগ্রহ করে মংডু চার মাইল নামক এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে অন্তরীন করে রাখে। টংবায় এলাকায় যেমন- আমি, বাদশা মিয়া, আলী মিয়া, প্রফেসর মোস্তাক আহামদ, আলী আহামদ সিকদার, বদিউর রহমান সিকদার, মোজাম্মেল, এ.কে.এম. মোজাম্মেল, মনিরুল হক চৌধুরী, নুর আহাম্মদ সিকদার, শমসের আলম চৌধুরী, আবছার কামাল চৌধুরী, ওসমান সরওয়ার আলম, ডাঃ শামশুদ্দিন, এস.কে. শামশু, সুরুত আলম, এস.এন.এ.নুর আহাম্মদ, প্রিয়দর্শী বড়–য়া, অমিত শ্রী বড়–য়া, সুনীল (জাতীয় ফুটবলার), ইব্রাহীম প্রমুখকে নানা ক্যাম্পে বন্দী করে রাখে। ইতিপূর্বে আতাউর রহমান খান কায়সার চট্টগ্রাম থেকে কয়েক জনের একটি গ্রট্টপ নিয়ে আসলে তাদের প্রস্তুতির জন্য কক্সবাজার জয়বাংলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ৩টি রাইফেল তুলে দেই।তারা নৌ পথে বাঁশখালী হয়ে ভারতে চলে যান। ৬ই মে ক্যাপ্টেন হারুনকে আহত অবস্থায় ভালুকিয়া রেজু ক্যাম্প হয়ে র্দূগম পাহাড়ী পথে দোলনায় করে শমশের আলম চৌধুরী, আবছার কামাল চৌধুরী প্রমূখ নিয়ে যান। আকিয়াব মন্ডু প্রশাসন তাকে চিকিৎসা করে। র্বামায় শরণার্থীদের এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে, এক পাড়ায় থেকে অন্য পাড়ায় যাতায়াত নিষেধ করে দেয়। এমনকি ওখাকার মুসলমানদেকেও এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাতায়াত নিষেধ করে দেয়। তিনি বলেন , এই ফাঁকে ক্যাম্প এলাকার অভ্যন্তরে আমরা অত্যন্ত গোপনে কয়েকটি মিটিং করি। আমি, প্রফেসর মোস্তাক আহামদ, মোজাম্মেল, এ,কে,এম মোজাম্মেল ,মনিরুল হক চৌধুরী, বাদশা মিয়া চৌধুুরী, নুর আহাম্মদ সিকদার, আলী মিয়া চৌধুরী প্রমূখ। আমরাই এই মিটিং গুলো করতাম। এক পর্যায়ে আমি আত্থগোপন করি। র্বামার ড্রেস পড়ে ছদ্ধবেশে নাকখোরা, মৌলবী বাজার, বলি বাজার, সিকদার পাড়া, টংবয়ু, লায়া-লাওয়ে, মংডু প্রভৃতি শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে প্রায় ১৫ হাজার সক্ষম সশস্ত্র যুদ্ধে আগ্রহী দেশ প্রেমিক মুক্তিযুদ্ধার তালিকা তৈরি করি। অবশেষে সাড়ে ৪ মাইল ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হারুনের সাথে যোগাযোগ করে এক গোপন বৈঠকে পর্যায়ক্রমে দেশের যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরামর্শ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন হানাদার পযেন্টে ঝটিকা গেরিলা হামলা ও হানা দেওয়ার প্রস্তুতি নিই। এই সব বিষয়ে বার্মায় আমাদের নানান অসুবিধার কথা জানিয়ে এবং ১৫,০০০ যুবকের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে ভারতের বাংলা মিশনে চিঠি প্রেরণ করি এবং রেঙ্গুনে সরকারের উচ্চ পর্যাযে যোগাযোগের জন্য যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের জন্য আকিযাব যাওয়ার পথে এক পাহাড়ী গিরিপথে বার্মা পুলিশ আমাকে ধরে ৩ দিন বন্ধি রাখার পর “সিনতারা স্টীমারে” করে টংবায় ক্যাম্পে ফেরৎ নিয়ে আসে। দৈনিক সকাল-সন্ধা আমি সহ অনেককে হাজিরা এবং মাটিকাটা ও জঙ্গল সাফ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ভারতস্থ ভারতস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে আমার চিঠির উত্তর আসে। এর মধ্যেও ৫০ জনের ৫টি গ্রুপকে দেশে পাঠানো হয়। এইভাবে একে একে ৫টি গ্রুপ দেশের ভিতর পাঠানো হয়। এর মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি গ্রুপ, বালুখালীর একটি গ্রুপ, সুবেদার মোল্লা গ্রুপ, হাবিলদার সোবহান গ্রুপ, সুবেদা নুর আহমদ গ্রুপ পরে আমি নিজে একটি ট্টোপ নিয়ে দেশে প্রবেশ করি। এদের কাজ ছিল শান্তি বাহিনী ও রাজাকার মেরে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া এবং হানাদার বাহিনীর সাথে মুকাবেলা করা ও গ্রুপের মাধ্যমেই বার্মা, আলী কদম, চুনতী বিট নিরস্ত্র করা হয়, বিভিন্ন ব্রীজে অপারেশন করা হয়। ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাাহে সুবেদার নুর আহামদের ছোট একটি গ্রুপ রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মূল নেতৃত্বে আমাদের জয় বাংলা বাহিনী৭১ গ্রুপ, সাথে ধুমধুম গ্রুপ কক্সবাজার শহরের দিকে রওনা দি। ১১ই ডিসেম্বর কক্সবাজার শহরের প্রানকেন্দ্রে এসে উপস্থিত হই। এসে থানা, বিধ্বস্থ বিমান বন্দর, হানাদার কিলিং ক্যাম্প, বীচ রেষ্ট হাউস, সাগরিকা এলাকা রেকি এবং চার্জ করে পাবলিক হলের মাঠে এসে যুদ্ধ বিধ্বস্থ জনাকীর্ণ সমাবেশে সকাল ১০ টায় প্রথম বাংলাদেশ পতাকা উত্তোলন করি এবং কক্সবাজার জেলাকে হানাদার মুক্ত ঘোষনা করা হয়। পরে জিপের উপর দাড়িয়ে মুক্তিকামী হাজার জনতার উদ্দ্যোশে অতি জরুরী দিক নিদের্শনা মূলক ভাষন দান করি। ১২/১২/৭১ মোজাম্মেলকে (মরহুম) মহেশখালী থানা নিরস্ত্র করার জন্য একটি গ্রুপ নিয়ে পাঠিয়ে দেই। এই গ্রুপে ছিল মোজাম্মেল (মরহুম), মুজিব, কাদের, আলতাফ, মালেক, অনিল, নজির আহমদ চৌং, বালুখালীর প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান প্রমূখ। ১৩ ও ১৪ তারিখ রেজু নদীর মোহনায় মিত্র বাহিনীর সৈন্য নামা শুরু হয়, আমরা তাদেরকে কক্সবাজার আসার ব্যবস্থা করি। এই সময়ে আমরা জয় বাংলা বাহিনীর সিনিয়র নেতাদের নিয়ে “কক্সবাজার এডমিনিসট্রেটিভ কাউন্সিল” গঠন করি। এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলাম আমি নিজেই। ১৪ তারিখ থেকে বার্মা হতে শরনার্থীরা ফিরে আসতে শুরু করে। ১৪ তারিখ মিত্র বাহিনীর একটি বহর নিয়ে চকরিয়া কলেজ পর্যন্ত যাই এবং তাদেরকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়ে আমি কক্সবাজার ফিরে আসি। তিনি আরো বলেন, কক্সবাজার শহরে মিত্র বাহিনীর বিমান আক্রমনের ফলে হানাদাররা নৌ এবং জঙ্গল পথে বার্মার দিকে চলে যায়। ১৫ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন হারুন বার্মা থেকে ফিরে এসে অনেক খোঁজা-খঁজির পর আমাকে পেয়ে তৎকালীন এস,ডি. ও’র অফিসের সামনে তার নিজের ব্যবহারের ১টি পিস্তলটি উপহার হিসাবে আমাকে দিয়ে বলেন, “এটা আপনারই প্রাপ্য”। অনেক কঠিন দায়িত্ব বাকী আছে। পরে দেখা হবে। একথা বলে তিনি বিদায় নেন। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ সম্পূর্ণরুপে শক্র মুক্ত হলে পরে স্থানীয় হোটেল সায়মানের লবিতে ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী চট্টগ্রামে শশুর বাড়ীতে মুরুব্বীদের দেখতে যাওয়ার প্রাক্কালে আকার-ইঙ্গিতে অনুনয় করে নিজ নিরাপত্তার কথা ব্যক্ত করলে, আমি বলি,“আমার হাতের এ পিস্তলটা, আপাততঃ নিয়ে যান”। তিনি বলেন, “নাতি, ঠিক আছে। আমি এসে এটা তোমাকে ফেরৎ দেব” কিন্তু অদ্যাবধি আমি এটা আর ফেরৎ চাইনি বা এ বিষয়ে কোন দিন আলাপও করিনি। তিনি পরিশেষে বলেন, সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে ১৯৭১-৭২ইং সালে বিচক্ষনতার সহিত স্বয়ং মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি পদঅলংকৃত করে ক্রীড়াঙ্গন, বিভিন্ন খেলাধুলায় মুখরিত করে তুলি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় পূর্ণ লেখাপড়া ব্যবস্থা করি এবং যুব সম্প্রদায়কে দেশ গঠনে উৎসাহিত করি। পাশাপাশি নিরক্ষরতা দুরীকরণ ও শিক্ষা বিস্তারে অনুরাগী করি। লাইব্রেরী, মক্তব সৃষ্টি, স্বেচ্ছা শ্রমে রাস্তা নির্মাণ কাজে ধাবিত করি। তিনি ৫০টিরও অধিক প্রতিষ্ঠানের দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা। এমনকি, বিরুধী নেত্রী থাকা কালিন শেখ হাসিনাকে, কামাল চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে এক বিরাট সংবর্ধনা দেন। এতে খালেদা সরকাররে কাছে কামাল হোসেন চৌধুরী লাঞ্ছনা-গজঞ্ছনার শিকার হন। হানাদার মুক্ত কক্সবাজারে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর পাবলিক লাব্রেরীর মাঠে, জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান রুপে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। সেকাল থেকে আজবধী দেশ জাতি গঠনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। অথচ দারুন আত্মপ্রচার বিমুখ মানুষটি, জাতীয় পুরস্কার লাভ, অতিব বাঞ্চনিয়। সর্বজন শ্রদ্ধাবাজন নিরহংকার নির্লোভ – আজীবন নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব – জনগনের অত্যন্ত সজ্জন কামাল হোসেন চৌধুরীর বর্ণাঢ্য জীবনের আলেখ্য বর্ণনাতীত। তার এরূপ বর্ণাঢ্য ও সামাজিক জীবনের শেষ পর্যায়টুকু শোভন হোক, হোক সুন্দর- উজ্জ্বলতর।
পাঠকের মতামত